যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধীরে চলা শহরের তালিকায় চট্টগ্রামের অবস্থান ১২তম। ১৫২টি দেশের ১২শ’র বেশি শহরে যান চলাচলের গতি বিশ্লেষণ করে এই চিত্র উঠে এসেছে।
জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ অনুসারে, ৬০ বর্গমাইলের এ শহরে বর্তমানে জনসংখ্যা ৩২ লাখ ৩০ হাজার ৫১৭ জন। শহর এবং উপজেলা মিলিয়ে পুরো চট্টগ্রাম জেলার জনসংখ্যা ৯১ লাখ ৬৯ হাজার ৪৬৪ জন বলে জানান চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিসংখ্যান অফিসের পরিচালক মো. ওয়াহিদুর রহমান।
তবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসেবে, শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এছাড়া ভাসমান আছে আরো ১৫ লাখ।
এই বিপুল জনগোষ্ঠীর তুলনায় পর্যাপ্ত নয় গণপরিবহনের সংখ্যাও। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় প্রায় ৩ লাখ যানবাহন আছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল প্রায় ১ লাখ ৫২ হাজার, ৩৬ হাজারের বেশি ব্যক্তিগত গাড়ি। নগরে চলাচলরত বাসের সংখ্যা ২ হাজার ৯৯টি। ২ লাখ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। প্রায় ৩০ হাজার চালকের লাইসেন্স নবায়ন হয় না দীর্ঘদিন। প্রতিদিন ১৫-২০টি নতুন গাড়ির লাইসেন্স এর জন্য আবেদন জমা পড়ছে।
নগরে রাস্তা আছে এক হাজার ১৬৯ কিলোমিটার, এর মধ্যে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক। কয়েক দশকেও সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠায় শহরে যানজটের সমস্যা থেকে মুক্তি মিলছে না। বন্দরনগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, যানজট নিরসন এবং সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা প্রণয়নের লক্ষ্যে গত ২৮ বছরে গ্রহণ করা হয় তিনটি মহাপরিকল্পনা।
১৯৯৫ সালে প্রণীত মহাপরিকল্পনায় স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী কৌশলগত উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। সেখানে ফুটপাতের উন্নয়ন, উন্নতমানের বাস সার্ভিস চালুর মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের কথা বলা হয়েছিল। এছাড়া শহরের ট্রাফিক এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য স্থায়ী কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা ইউনিট গঠনের কথাও বলা হয়। ২০০৮ সালের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) এবং ২০১৮ সালের স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যানে প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের কথা বলা হয়। কিন্তু তার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি।
সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের তথ্যমতে, ১৩ বছর আগে চট্টগ্রামে যানবাহনে গতি ছিল ঘন্টায় ২১ কিলোমিটার। বর্তমানে যানবাহনের গড় গতি ৫ কিলোমিটার। ট্রাফিক কর্মকর্তারা বলছেন, সড়কে উন্নয়ন কাজ, সিগন্যাল বাতি না থাকা এবং চালক, মালিক ও যাত্রীদের অসচেতনতার কারণে যানবাহনে পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি মাসে আইন অমান্যকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলার বিপরীতে জরিমানা আদায় করছে ট্রাফিক পুলিশ। এত ব্যবস্থা নেওয়ার পরও থামছে না আইন ভঙ্গের প্রবণতা।
মহানগরীতে তিন ধরনের গণপরিবহনের জন্য ৪৬টি অনুমোদিত রুট আছে। এর মধ্যে অটো টেম্পোর রুট ১৬টি, হিউম্যান হলারের রুট ১৬টি এবং বাস-মিনিবাসের রুট আছে ১৪টি। এসব অনুমোদিত রুটের বাইরে বিভিন্ন শ্রমিক-মালিক সংগঠন আরও ৪০টি অবৈধ রুট সৃষ্টি করেছে। অনুমোদনহীন রুটে চলছে হাজারও যানবাহন। যার অধিকাংশই ত্রুটিপূর্ণ ও বিআরটিএ’র নিবন্ধন নেই। এসব রুটে যাত্রী পরিবহন, যাত্রী ওঠানামায় নেই কোনো শৃঙ্খলা।
সিএমপির রুট জরিপ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গণপরিবহনে রুট অনুমোদন দেওয়া আছে ১ হাজার ১৩৪টি বাস, ১ হাজার ১৪১টি হিউম্যান হলার ও ১ হাজার ৬৬০টি অটো টেম্পোর। তবে এর বেশি যানবাহন চলছে এসব রুটে।
চিটাগং স্ট্র্যাটেজিক আরবান ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যানের জরিপে দেখা গেছে, নগরে চলাচলরত যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে কম গতি বাসের। সকালে বাসের গতি ঘণ্টায় ১৩.৯ কিলোমিটার এবং বিকেলে ১০.৩ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত গাড়িগুলোর সকালে গড় গতি ১৮.৩ কিলোমিটার এবং বিকেলে কমে দাঁড়ায় ১০.৭ কিলোমিটারে। চট্টগ্রামে দৈনিক ৬.৭ মিলিয়ন ট্রিপ হয়। এর মধ্যে সিএনজি অটোরিকশা এবং রিকশায় ২২ শতাংশ, পায়ে হাঁটার মাধ্যমে ২৫ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ ট্রিপ ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ির মাধ্যমে হয়। যানবাহন ব্যবহারকারী ৮৩ শতাংশ মানুষ ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়িতে প্রবেশাধিকার পান না। ৬৫ শতাংশ যাত্রীর যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম গণপরিবহন।
ধীরগতির কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, শহরে মোট সড়কের ৪৩ শতাংশ ব্যবহার করে বাস, হিউম্যান হলার ও টেম্পো। ২৯ শতাংশ সড়ক দখল করে থাকে ব্যক্তিগত গাড়ি। এসব গাড়িতে যাতায়াত করেন ১৩ শতাংশ মানুষ। সড়কের ১৭ শতাংশ জায়গা দখল করে ৪৮ শতাংশ যাত্রী বহন করে বাস। ২৭ শতাংশ সড়ক সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশার দখলে থাকে। এসব পরিবহনে যাতায়াত করেন ১৬ শতাংশ মানুষ। ৬ শতাংশ জায়গা দখল করে ১২ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করে টেম্পো। এ ছাড়া সড়কের ৭ শতাংশ জায়গা দখল করে ১০ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করে হিউম্যান হলার। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে নগরে বছরজুড়ে উন্নয়নকাজ।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, চট্টগ্রাম নগরে প্রতিদিন যাত্রী ট্রিপ হয় ৬.৭ মিলিয়ন যা ২০৩০ সালে হতে পারে ১০.৪ মিলিয়ন ট্রিপ। নগরীতে যানবাহনের মধ্যে বাস-মিনিবাস ৮ শতাংশ, প্রাইভেট কার ১০ শতাংশ, সিএনজি অটোরিকশা ৩৯ শতাংশ এবং রিকশা ৪৩ শতাংশ। তাই গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে।
‘চট্টগ্রামে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) এর জন্য করিডোর ঠিক করা আছে। বিআরটি চালুর মাধ্যমে নাগরিকদের গণপরিবহনমুখী করতে হবে। অর্থাৎ নগরীর সড়কগুলোতে বাসের জন্য আলাদা লেন করতে হবে, যাতে বাসে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। ফলে ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে আর ঝুঁকবে না যাত্রীরা’।
মন্তব্য করুন